সুচিপত্র
ধারাবাহিক গল্পঃ ইসলামিক স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প (Islamic Love story of husband and wife)
প্রথম প্রথম আমি একদমই আনাড়ি ভাব নিয়ে শাশুড়ি মায়ের কাছে রান্না শিখতাম। কত বকা যে খেয়েছি, রান্নায় আনাড়ি বলে, তা বলার বাইরে। প্রতিদিন নিয়ম করে রান্না করতাম মায়ের সাথে। মাঝেমাঝে হাত পুড়ে যেত, আমি মাছ কাটতে পারতাম না, প্রথম প্রথম কাটতে গেলে হাত কেটে যেত, আমার শাশুড়ি মায়ের একটা অভ্যাস হলো, তরকারির যেই আইটেমই থাকুক না কেন, গোটা এলাচ ছাড়া রান্না করলে মা মুখে তুলতে পারতেন না, মায়ের মনমতন করে রান্না শিখছিলাম। বড় জা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকুরীরত ছিলেন, আমার শায়খ সকাল নয়টায় বের হতেন, ফিরতেন রাত নয়টায়।
আর দেওররা সকাল দশটা-এগারোটার পর কেউ ঘরে থাকতো না বললেই চলে। পুরো বাড়িতে আমি আর মা!তাই অনিচ্ছাবশত হলেও মাকে আমার সাথে কথা বলতেই হতো। আমি প্রতিদিন বিকেল বেলা মায়ের চুলে তেল লাগিয়ে দিতাম, বেণী করে দিতাম। প্রথম প্রথম মা অবজ্ঞা করলেও, ধীরে ধীরে তিনিও আমার সাথে ফ্রি হচ্ছিলেন। একদিন লাজ লজ্জা একপাশে সরিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে চোখ নিচু করে, লজ্জা লজ্জা ভাব এনে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“মা!নাতী লাগবে? নাকি নাতনী? ”
মা কিছুক্ষণ আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে থেকে তেড়ে আসলেন। আমার আম্মাকে ফোন করে একগাদা বিচার দিলেন আমার নামে। পরে অবশ্য নিজেই হাসতে হাসতে বলেছিলেন, একটা নাতনী লাগবে উনার। না না!নাতনী না, বোন লাগবে উনার। জিজ্ঞেস করলেন, কবে দিতে পারব!
শুনে লজ্জায় আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কোনোমতে রুমে ফিরে শায়খের সাথে কপট রাগ দেখাচ্ছিলাম। আসলে এই প্ল্যানটা উনারই ছিলো তো!
ধীরে ধীরে মায়ের সাথে আমার দূরত্ব কমে আসছিল। তবে মায়ের মনে ক্ষোভ ছিল, আমাদের আলাদা ঘরের জন্য। একদিন ইশার পর আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আসলেই কি আলাদা ঘরের প্রয়োজন ছিল?
আমার শায়খ হেসে উত্তর দিলেন,
–এটা তোমার হক তো আমিনা। জানোই তো হাদিসে আছে দেওর ভাবির জন্য মৃত্যুর সমান। আর তোমার তো একটাও ননদ নেই, সবাই ই দেওর, গায়রে মাহরাম। এদের সাথে তো তোমার পরদা ফরজ, তাইনা? তোমার যাতে পর্দার সমস্যা না হয়, ফ্রিলি মুভমেন্ট করতে পারো,
তাই ই আমায় আলাদা ঘর করতে হয়েছে।
–কিন্তু এতে লাভ কি? আমায় তো দিনের সিংহভাগ সময় ই ওই ঘরে থাকতে হয়। যদিও পর্দা করি, কিন্তু অস্বস্তি লাগে খুব!
–আশা করা যায় খুব বেশীদিন তোমায় এই কষ্ট সহ্য করতে হবেনা আমিনা! সবর করো!!!!!!
–আচ্ছা, আপনাদের বাড়ির আশেপাশে কোনও তালিম হয়না, মহিলাদের নিয়ে?
–উঁ, বলতে পারছিনা। আগামীকাল খোঁজ নিয়ে জানাব ইনশাআল্লাহ!এখন আসো তো, ঘুমানোর দুআ পড়ি, জানো না, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও ইশার পর বেশী রাত জাগাকে পছন্দ করতেন না?
–তা তো জানি। কিন্তু আপনি মনে হয়, কিছু একটা ভুলে যাচ্ছেন।
–ভুলে যাচ্ছি? !কি বলো তো!
–আপনি কি ভুলে গেলেন, বুখারী শরীফে আছে, ঘুমানোর আগে উযু করা সুন্নত? !অথচ আজ আপনি উযু না করেই শুয়ে পড়েছেন!
–ইশ!একদম ভুলে গিয়েছিলাম। শুকরিয়া আমিনা, মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, আমি এখনই আসছি।
উযু করে এসে শায়খ দুই রাকাত নামায পড়লেন দেখলাম। আমি তো অবাক হয়ে গেছি!কি অদ্ভুত!!একটু আগেই না তিনি মাসজিদ থেকে এলেন, আমার কোলে মাথা রেখে কুরআনও পড়লেন। এখন আবার কিসের নামায!
উনি সালাম ফিরিয়ে উঠতেই উনাকে বললাম,
–এটা কিসের নামায ছিল!?
–এটা? এটা তো তাহিয়্যাতুল উযু ছিল। উযুর পর দুইরাকাত নফল নামায পড়া।
–এটা কেন পড়লেন? মানে, এটার ফজিলত কি?
–এটা সুন্নাহ তো। রসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার অজুর মতো অজু করে এমভাবে দুই রাকাআত নামাজ পড়বে যে তার মনে কোন অন্য কোন ধারণা/কল্পনা জাগ্রত হবে না বা মনে মনে অন্য কোন কথা চিন্তা করবে না তাহলে তার পূর্বের সকল সগীরা গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’।
–কই!এতদিন তো এই নামায সম্পর্কে বলেন নি আপনি। মানে আপনি জান্নাতে একা ই যেতে চান, তাইতো? বুঝলাম।
আমি অভিমানের সাথে এটুকু বলে ওপাশ ফিরে শুয়েছিলাম। তিনি আমায় টেনে তার কাছে আনলেন।
–এই যে আমিনা!শুনুন, অভিমান, অভিযোগ, রাগ, দুঃখ, কষ্ট সব স্বামীর বুকের মাঝে এসে করবেন, বুঝলেন? এতে ভালবাসা বাড়বে।
–লাগবেনা ভালবাসা, যে আমাকে জান্নাতে নিতে চায়না, তার জন্য কিসের ভালবাসা? ছাড়ুন আমাকে।
–না ছাড়লে কি করবে শুনি? সেদিনের মতন কুঁই কুঁই করে বলবে, “আই নিড সাম টাইম!!!!!!”
বলে হেসে উঠলেন তিনি। প্রায়সময় ই সেদিনের এই কথাটা বলে রাগান উনি আমাকে। আমি আগে রাগলেও, এখন আর রেগে যাইনা। নিজের বোকামির কথা মনে পড়লে নিজের ই লজ্জা লাগে।
–আমিনা!একটা কথা বলবো, যদি কিছু মনে না করো!!!!!!
–ওমা!কি মনে করব আবার? বলেন তো।
–না, আসলে!!!!!!
সেদিন দেখলাম গায়রে মাহরাম কয়েকজন তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। পাশাপাশি তুমি উনাদের দাওয়াত দিচ্ছো। এটা তো ঠিক না আমিনা!
–কেন? ঠিক না কেন? আমি তো বেহুদা আলাপ করছিনা। দ্বীনের দাওয়াত ই দিচ্ছি, তাহলে সমস্যা কোথায়?
–ও আমিনা!তুমি জানো, সূরা আহযাবের বত্রিশ নং আয়াতে তোমাকে আদেশ করা হয়েছে, গায়রে মাহরামের সাথে কথা বলায় কঠোরতা অবলম্বন করতে। এতে করে তার তোমার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। আর এটা তো জানো ই, দ্বীনের দাওয়াতে কঠোরতা অবলম্বন করতে পারবে না। এর বিরুদ্ধে স্পষ্টত নিষেধাজ্ঞা আছে।
–কিন্তু!!!!!!
–দাঁড়াও বুঝিয়ে বলি। দাওয়াত দেওয়ার নিয়ম হচ্ছে, দায়ীকে অবশ্যই ই বিনয়ের সাথে, নম্রতার সাথে, কোমল ভাবে দাওয়াত দিতে হবে। দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে কোনওভাবেই কঠোরতা অবলম্বন করা যাবে না। পাশাপাশি নারীর উপর আদেশ আছে, পরপুরুষের সাথে কথা বললেই কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। তাহলে তুমিই বলো, একজন নারী একজন গায়রে মাহরামকে কিভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিবে, যেখানে তার উপর আদেশ আছে কঠোরতা অবলম্বন করার, আর দাওয়াত দানের মূল শর্তই হলো কঠোরতা অবলম্বন না করা? এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যাচ্ছে না?
–তা ঠিক, কিন্তু আমি তো সরাসরি বলছি না।
–জীবন যাপনের ক্ষেত্রে অনলাইনের বিধানগুলো সম্পূর্ণ অফলাইনের মতনই হবে গো আহলিয়া। পাশাপাশি দেখ, এটা ই শেষ নয়, গায়রে মাহরামের সাথে কথা বলা তখনই জায়েজ, যখন সেখানে ওযর থাকবে, পাশাপাশি পরস্পর পরস্পরের উপর আকৃষ্ট হওয়ার আশংকা ও থাকবে না। কিন্তু তুমি একটা বিষয় ভাবো, তুমি যখন গায়রে মাহরাম কাউকে দাওয়াত দিবে, তখন সে কিন্তু আপনাতেই তোমার প্রতি মুগ্ধ হবে। বারবার ভাববে,
“আল্লাহ!এই মেয়েটা এত জানে!!”
ব্যস!বদনজর লেগে যাবে।
–বদনজর? !আপনি বদনজরে বিশ্বাস করেন?
–করব না কেন? এটা নিয়ে কত হাদিস আছে জানো? এই বদনজর একজন মানুষকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যে, কবর পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
–বুঝলাম, তারপর?
–এই দেখো, দ্বীনের লেবাসে শায়ত্বান হাজির!!জানোই তো নারীর জন্য পুরুষ আর পুরুষের জন্য নারীর জন্য পুরুষের চেয়ে বড় ফিতনা আর কিছু নেই। পাশাপাশি দেখো, একজন নারী আর একজন পুরুষ নির্জনে থাকলে সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শায়ত্বানের উপস্থিতি থাকে। আর জানোই তো, শায়ত্বান আদম সন্তানকে পথভ্রষ্ট করার জন্য কত কু প্ররোচনা দেয়। এইজন্যই তো দেখো না, বাবা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষণ, ভাই কর্তৃক বোন ধর্ষণ, পরিবারের পুরুষ সদস্য, পাশের বাড়ির প্রতিবেশী কর্তৃক সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এখন অহরহ হচ্ছে।
–কিন্তু অনলাইনে কি আমরা নির্জনে থাকছি নাকি?
–ইনবক্স!!ইনবক্স তো নির্জন স্থানই, তাইনা বলো?
–বুঝলাম এটা। কিন্তু একটা বাড়তি প্রশ্ন, সেদিন আমি একটা ফাতওয়া পড়েছিলাম, নারীর কণ্ঠস্বর পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলে?????
–হু, যথার্থ পড়েছ। নারীর কণ্ঠস্বর পর্দার অন্তর্গত নয়। কিন্তু খেয়াল করো, প্রতিবারই কথা বলা তখন জায়েজ হবে, যখন কথা বলার একান্ত জরুরত হবে, পাশাপাশি আকৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থাকবে না।
–তাহলে আপনিই বলুন, আম্মাজান আয়শা কি হাজার হাজার সাহাবাকে হাদীস শিক্ষা দেন নি? কিভাবে দিয়েছেন?
–উনি দিতে পেরেছেন, কারণ পরিস্থিতি উনার অনুকূলে ছিল। রসূলুল্লাহর ওফাতের পর তার স্ত্রীদের অন্য পুরুষ কর্তৃক বিবাহ করা হারাম ছিলো। পাশাপাশি সাহাবাদের ঈমান এতই তেজদীপ্ত ছিলো যে, তারা দৃষ্টি অবনত রাখতেন, আম্মাজানের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া তো দূর কি বাত, সর্বদা সকল প্রকার কলুষতা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তোমার পরিস্থিতি তো ভিন্ন, তাইনা বলো?
আমি চোখ বন্ধ করে মনের গভীর থেকে রব্বের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। আর আমার শায়খকে যাতে ইহকাল আর আখিরাত, উভয় কালেই জাযাহ দেন, তা প্রার্থনা করলাম। চোখ খুলে দেখি আমার শায়খ ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এবার আমি ঠিক উনার উল্টোটা করলাম, তাকে চোখ মারলাম!!
প্রথমবারের মতন। তারপরই মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগিন করলাম। এখন আমার কি করণীয়, আমি তা জানি।
ইনশাআল্লাহ চলবে!!!!!!
উপসংহার
এটি একটি ইসলামিক স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প, যারা ইসলামিকভাবে তাদের বিবাহিত জীবনকে গড়ে তুলেছে। যদি আমাদের ইসলামিক স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প পর্ব – ৮ (Islamic Love story of husband and wife episode – 8) গল্পটি ভালো লাগে তাহলে শেয়ার করুন। ইসলামিক স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প পর্ব – ৮ (Islamic Love story of husband and wife episode – 8) গল্পটির ধারাবাহিকতা অনুসরন করতে ইসলামিক স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প ১২টি পর্ব (Islamic Love story of husband and wife 12 part) পোস্টটি আলোকপাত করুন।
অনলাইন কোরআন ও হাদিসসমূহের লিঙ্ক বাংলা হাদিস বিডি